দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি কেনায় অনিয়মের অভিযোগে মামলা চলছে। আছে ভর্তি বাণিজ্যের অভিযোগ। এ ছাড়া সাধারণ তহবিল থেকে ট্রাস্টিদের আর্থিক সুবিধা ও সিটিং অ্যালাউন্সের নামে মোটা অঙ্কের অর্থ গ্রহণ ও বিদেশ ভ্রমণের ঘটনা তদন্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। একটির অনুমতি নিয়ে চালানো হচ্ছে একাধিক প্রোগ্রাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় কেনা বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করছেন ট্রাস্টি বোর্ডের একাধিক সদস্য। প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর জাল করে কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের ঘটনায় মামলা পর্যন্ত হয়েছে। তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে উপ-উপাচার্য পদে নিয়োগ দেননি চ্যান্সেলর। এ পদে যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তাকে যোগদানে বাধা দেওয়ার ঘটনাও আছে।

অভিযোগ উঠেছে, বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) কয়েক সদস্য প্রতিষ্ঠানটি কুক্ষিগত করে রেখেছেন। ওইসব ব্যক্তিই ঘুরেফিরে বিওটির চেয়ারম্যান পদে আসছেন। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে রেখেছেন তারা। গত ৬-৭ বছরে এসব অভিযোগ একাধিকবার তদন্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। সর্বশেষ শাস্তি হিসেবে ইউজিসির ওয়েবসাইটে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নামের তালিকায় এনএসইউকে ‘স্টারমার্কড’ করে রাখা হয়েছে। সেখানে অননুমোদিত প্রোগ্রাম পরিচালনার তথ্যও উল্লেখ আছে। এ ছাড়া গুগল সার্চ ইঞ্জিনে গেলে উইকিপিডিয়ায় ‘কনট্রোভারসিজ’ নামে একটি প্যারায় ২০১২ সাল থেকে ইউজিসির তদন্তে দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসার কথাও স্থান পেয়েছে। বিগত কয়েক বছরে ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনগুলোর সুপারিশ অনুযায়ী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা পর্যালোচনা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ব্যাপারে ইউজিসিতে তথ্য চাওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভিন্ন অভিযোগের ব্যাপারে সম্প্রতি আলাপ হয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে জানান, যথাযথ কাগজপত্রের ভিত্তিতেই তারা বিভিন্ন প্রোগ্রাম চালাচ্ছেন। ইউজিসির ওয়েবসাইটে ‘স্টারমার্কড’ করে রাখা অযৌক্তিক। এর পরও ইউজিসি যেহেতু আপত্তি জানিয়েছে, তাই তারা প্রোগ্রাম অনুমোদন করানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সময়ে ইউজিসি তদন্ত নানা পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। সে অনুযায়ী তারা পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিছু বিষয় নিয়ে কথা আছে। সেগুলো আমি এ পদে যোগদানের আগের। কাজেই সে সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।

জমি কেনা : সূত্র জানায়, জমি কেনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। ২০১৪ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির তহবিল থেকে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি হাউজিং কোম্পানির কাছ থেকে জমি কেনা হয়। অথচ ওই জমি কেনার ব্যাপারে বিওটির সদস্যদের মধ্যে মতানৈক্য ছিল। এ নিয়ে বিওটির ওই সময়ের সদস্য ড. রওশন আলম আদালতে মামলা করেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, জমি কেনা নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ তুলে সম্প্রতি ট্রাস্টি বোর্ডের দুই সদস্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করেন। এতে তারা উল্লেখ করেন, বোর্ডের অধিকাংশ সদস্যকে না জানিয়েই সভায় ৫০০ কোটি টাকায় জমি কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জমির বায়না পরিশোধের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ড থেকে ২৫০ কোটি টাকা উত্তোলনের বিষয়ও তারা এতে তুলে ধরেন।

গাড়িবিলাস : বিশ্ববিদ্যালয়টির অর্থ নিয়ে নয়ছয়ের সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে ২০১৯ সালের জুনে। এসময় বিপুল অঙ্কে টাকায় বিলাসবহুল সাতটি গাড়ি কেনা হয়। শিক্ষার্থীদের বেতন-ফির টাকায় কেনা এসব গাড়ি ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ আছে। রেঞ্জ রোভার ২০১৯ মডেলের প্রতিটি গাড়ি কেনায় ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রায় ৩ কোটি টাকা। নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় যে ট্রাস্টের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত তার ডিডে বলা আছে, মানবহিতৈষী, দানশীল, জনহিতকর, অরাজনৈতিক, অলাভজনক ও অবাণিজ্যিকভাবে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হবে। ট্রাস্ট অর্থের জোগান দেবে। সেই প্রতিষ্ঠান থেকে ট্রাস্টিদের গাড়িসহ অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা গ্রহণের সুযোগ নেই বলে জানান আইনজীবীরা। জানা গেছে, গাড়িগুলো কেনার সময়ে বিওটির চেয়ারম্যান ছিলেন ট্রাস্টি এমএ কাসেম। তিনি এ যাবত চারবার বিওটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। অপর সদস্য আজিম উদ্দিনও এখন পর্যন্ত চারবার চেয়ারম্যান হয়েছেন বিওটির। বোর্ডে এমএ কাসেম ও আজিম উদ্দিন একই মতের লোক বলে জানান অন্য সদস্যরা। তাদের অভিযোগ, এ দুজনের কারণে অন্য ট্রাস্টিরা কোনো সুবিধা করতে পারছেন না। যে কারণে চাইলেও অন্যায়-অনিয়ম ঠেকাতে পারছেন না তারা।

লাল তারকা চিহ্নিত : ইউজিসির ওয়েবসাইটে দেখা যায়, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি লাল তারকা চিহ্নিত হয়ে আছে। কমিশন থেকে শুধু বিবিএ প্রোগ্রাম অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিবিএ ইন জেনারেল বিবিএ, এইচআরএম, বিবিএ ইন ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, বিবিএ ইন মার্কেটিং, বিবিএ ইন ম্যানেজমেন্ট, বিবিএ ইন ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস, বিবিএ ইন অ্যাকাউন্টিং, বিবিএ ইন ইকনোমিক্স, বিবিএ ইন এন্টারপ্রেনারশিপ, বিবিএ ইন সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামগুলো চালাচ্ছে। এছাড়া প্রতি সেমিস্টারে শুধু বিবিএতে ৫০ জন ভর্তির অনুমোদন থাকলেও এর চেয়ে অনেক বেশি ভর্তি করা হচ্ছে। একাধিক শিক্ষার্থী যুগান্তরকে জানান, উল্লিখিত বিভাগে পড়ে তারা খুবই বিপাকে আছেন। বিশেষ করে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া এবং ইমিগ্রান্টের জন্য আবেদন করে বিপাকে পড়ছেন। তারা বলেন, যখন এসব সনদ ও ট্রান্সক্রিপ্ট ইসিএ (এডুকেশনাল ক্রেডেন্সিয়াল অ্যাসেসমেন্ট) করতে দেওয়া হচ্ছে, তখনই সংশ্লিষ্ট মূল্যায়নকারী সংস্থাগুলো ইউজিসির ওয়েবসাইট যাচাই করতে যায়। এরপর তারকা চিহ্নিত দেখে যথাযথ মূল্যায়ন করতে চায় না।

আরও যত অভিযোগ : ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বোর্ডের সদস্যরা অস্বাভাবিক হারে সিটিং অ্যালাউন্স নেন। একটা সময়ে বিওটির প্রতি বৈঠকের জন্য ১ লাখ আর অন্য সব কমিটির বৈঠকপ্রতি ৫০ হাজার টাকা করে নেওয়া হতো। মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি থেকে চাপ তৈরির পর উভয় ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ কমানো হয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, একটি বৈঠকে উপস্থিত হওয়ার জন্য ৫০ বা ২৫ হাজার টাকা করে নেওয়া কতটা যৌক্তিক। এক মাসে এমন একাধিক বৈঠক হলে এ খাতে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ আছে, এ সিটিং অ্যালাউন্স বাণিজ্যের লোভেই আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ১৭টি কমিটি গঠন করা হয়। এ নিয়েও ইউজিসি আপত্তি দিয়েছে।

ইউজিসির প্রতিবেদনে জানা যায়, বিওটির সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈঠক আর চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান। এর খরচ জোগানো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে। এটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের পরিপন্থি। এছাড়া বিভিন্ন প্রোগ্রামে বিওটির সদস্য ও উপাচার্যের কোটায় ছাত্রছাত্রী ভর্তি নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ বহু দিন ধরেই আছে।

২০১৬ সালের হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলা হয়। এর আগে ও পরে দেশে বিভিন্ন সময়ে জঙ্গি হামলা বা হামলার প্রস্তুতি নেওয়ার দায়ে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ এনএসইউর শিক্ষার্থী ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার তদন্তে নামে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। এ লক্ষ্যে গঠিত তদন্ত দল বিশ্ববিদ্যালয়টির লাইব্রেরি পরিদর্শন করে। সেখানে নিষিদ্ধ ঘোষিত হিজবুত তাহরিরের জঙ্গি তৎপরতামূলক কিছু বই পাওয়া যায়। তদন্ত কমিটি বলেছে, গ্রন্থাগারে এ ধরনের বই রাখা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৬(১০) ধারার লঙ্ঘন। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি বিবেচিত হওয়ায় লাইব্রেরির সংরক্ষিত নিষিদ্ধ সব বই পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সুপারিশ করে ইউজিসি।

জানা গেছে, কয়েকদিন আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাতে অতীতে ইউজিসির বিভিন্ন তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে তার আলোকে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানতে চাওয়া হয়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত সব আয়-ব্যয় নিরীক্ষার কথাও বলা হয়েছে। সিটিং অ্যালাউন্স, অননুমোদিত ১৭ কমিটি, জঙ্গি তৎপরতা, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ভর্তি, গবেষণা খাতে ব্যয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জবাব চাওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, চিঠি বিওটি পর্যালোচনা করছে। বোর্ড প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে বলে মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে।

উত্তর দিন

Please enter your comment!
Please enter your name here

one + thirteen =