সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮- বহুল প্রতীক্ষিত ও প্রয়োজনীয়। ৩৬ বছর আগের একটা আইন আজকের বাস্তবতায় একেবারে পুরোনো। ওই আইনে অনেক কিছুই ছিল না। যেমন সে সময় সিএনজি ছিল না, ইলেকট্রিক ভেহিকলও ছিল। আইনটির আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী জরুরি হয়ে পড়ে। ১৯৮৩ সালের পরিপ্রেক্ষিতে যে জরিমানা বা দণ্ড নির্ধারণ করা হয়, আজ সেটি খুবই কম। একটা নতুন আইন আরও আগে দরকার থাকলেও গত বছর ঢাকার দুই কলেজ শিক্ষার্থী সড়কে বাসচাপায় প্রাণ হারানোর পর শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সড়ক পরিবহন আইন পাস করে সরকার। প্রায় ১৪ মাস পর সেই বহুল আলোচিত ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’ ১ নভেম্বর থেকে বাস্ততবায়ন শুরু হয়। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অবশ্য বলেছেন, এক সপ্তাহ মামলা নয়; এ সময়ের মধ্যে ট্রাফিক পুলিশ কেবল আইন বিষয়ে সতর্ক করবেন। ঢাকার রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যালে মাইকিং করে এ বিষয়ে প্রচারও আমরা দেখছি। আইনটির বিধিবিধান এখনও তৈরি না হওয়া সত্ত্বেও জরিমানার সফটওয়্যার আপডেড না হওয়া এবং প্রচার এখনও সেভাবে না হওয়া সত্ত্বেও আইন কার্যকরে সরকারকে আমি সাধুবাদ জানাচ্ছি।

এতদিন পর যখন আইনটি হয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই এখানে জরিমানা ও দণ্ডের পরিমাণটা খুব বেশি মনে হচ্ছে। আগে যেখানে লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা বা ৪ মাসের জেল ছিল, এখন ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া মোটরযান বা গণপরিবহন চালানোর দায়ে ৬ মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া হয়েছে। আগে পথচারীদের যত্রতত্র পারাপার কিংবা অবৈধ পার্কিংয়ে জরিমানা ছিল সামান্য ২০০ টাকা। অনেক সময় সেটা কার্যকরও হতো না। মানুষও সেভাবে নিত না। আর এখন ট্রাফিক সংকেত মেনে না চললে এক মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার কথা বলা হয়েছে। সঠিক স্থানে মোটরযান পার্কিং না করলে বা নির্ধারিত স্থানে যাত্রী বা পণ্য ওঠানামা না করলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানাও এসেছে আইনে।

ফলে এসব বিষয়ে জানানো খুব জরুরি। আরও আগ থেকে জানালে, আইনটির প্রচার-প্রচারণা ব্যাপকভাবে হলে মানুষ জানত। তাতে সতর্ক হতো। সবার অভ্যস্ততা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। অন্তত ৬ মাস ধরে সচেতনতার কার্যক্রম চললে তারপর আইনটি কার্যকর হলে মানুষের অভ্যস্ততা তৈরি হতো, বোধোদয় হতো। আইনটিও স্বপ্রণোদিত হয়ে মানত। আমাদের মনে রাখা দরকার, আইন কিন্তু প্রয়োগের জন্য নয় বরং সচেতনতার জন্যই প্রণয়ন হয়। আইনের ব্যাপারে যখন প্রতিটি নাগরিক সচেতন হয়, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও কষ্ট করতে হয় না। তারপরও সমাজে এমন আছে যারা আইন ভাঙে। তাদের জন্য পুলিশ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। যা হোক, এখন জরিমানা কার্যকর হতে যেহেতু কিছুদিন বাকি আছে, এখন উচিত হবে আইনটির ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করা। পরিবহন সংশ্নিষ্ট সবার মাঝে যেমন এটি ছড়িয়ে দিতে হবে, তেমনি বিভিন্ন স্থানে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে যাত্রীসহ সবাইকে জানানোও জরুরি।

আমরা দেখি, ট্রাফিক আইনে হাজার হাজার মামলা হয়; কিন্তু সে তুলনায় পরিস্থিতির উন্নয়ন সামান্যই। বিদ্যমান দুর্বল আইন দিয়েই যখন অভিযান চালানো, তখন ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো চোখের আড়ালে চলে যায়। তখন রাজধানীতে সৃষ্টি হয় এক ধরনের হাহাকার। মানুষ অফিসে বা বাসাবাড়িতে যেতে বাস পায় না। মানুষের ভোগান্তি চরমে ওঠে। তখন স্বাভাবিকভাবেই গণতান্ত্রিক সরকার মানুষের দুর্দশার কথা চিন্তা করে আইন প্রয়োগে নমনীয় হয়। তাতে কিন্তু বিজয় তাদেরই হয়, যারা বেআইনিভাবে সড়কে আনফিট গাড়ি চালায়। এতে আইনও অসহায় হয়ে পড়ে।

নতুন আইন অত্যন্ত কঠোর হিসেবেই দেখছেন সবাই। এ জন্য একে ধাপে ধাপে প্রয়োগ করতে হবে। জনদুর্ভোগ এড়িয়ে কৌশলী হয়ে ধীরে ধীরে একে পূর্ণাঙ্গরূপে কার্যকর করতে হবে। সত্যিকার অর্থে আমাদের বিদ্যমান ব্যবস্থা চালু থাকলে একটি টেকসই ও নিরাপদ গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে না। বাস-মালিক এই প্রথা চালু রেখে লিজ-সর্বস্ব গণপরিবহন ব্যবস্থায় অবস্থার উন্নয়ন অসম্ভব। এ জন্য আমাদের পরিকল্পনায় ঘাটতি রয়ে গেছে। মহানগরীর সব গণপরিবহনকে চার থেকে ছয়টা করিডোরের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। গুলশান-বনানী-বারিধারায় যেমন ‘ঢাকা চাকা’ নামের একটা বাস চালু রয়েছে, একই আদলে হাতিরঝিলে আরেকটি চক্রাকার বাস সার্ভিসও চালু করা হয়েছে। সেখানে কেউ হুড়োহুড়ি করে বাসে ওঠে না। যাত্রীরা লাইন ধরে গাড়িতে ওঠেন। চালকদের মধ্যে কে কত যাত্রী নেবে সে প্রতিযোগিতা করতে হয় না। ঠিক একইভাবে কয়েকটা কোম্পানির অধীনে বাসগুলোকে পরিচালিত করলে চালকদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ হবে। চালককে বেশি যাত্রী তোলার জন্য আরেকটি বাসের আগে গিয়ে দাঁড়াতে হবে না। কারণ তখন তাকে বেতন দেবে কোম্পানি। হাতিরঝিল ও গুলশান-বনানীতে যেহেতু একটি পাইলট প্রকল্প করে সুফল পাওয়া গেছে, তাহলে অন্য সড়কে কেন এটা চালু করা যাবে না? বিদ্যমান ব্যবস্থা বাদ দিয়ে একটি অথরিটির মাধ্যমে এই পদ্ধতি চালু করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তখন সবার আয়েও সামঞ্জস্য আসবে। চালকও ভদ্র হতে বাধ্য। তাতে যানজট যেমন কমবে, তেমনি সরকারের ভাবমূর্তির উন্নয়ন ঘটবে বলেও আমার বিশ্বাস।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, মোড়ে মোড়ে সিগন্যালে শৃঙ্খলা আনয়ন। সিগন্যাল কার্যকর করতে না পারলে পথচারী-গাড়িতে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হয়। সিগন্যালে লাল বাতি জ্বলবে, গাড়ি বন্ধ থাকবে, পথচারী যাবে। আমাদের সিগন্যাল বসানো আছে ঠিকই, কিন্তু কার্যকারিতা সেভাবে নেই বললেই চলে। সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে মোড়ের বিশৃঙ্খলা, রাস্তার যানজট ও দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আমরা আইনে যান্ত্রিক যানের কথা বলছি; কিন্তু ঢাকার পরিবহন সমস্যার সমাধানে অযান্ত্রিক যান, বিশেষ করে রিকশাও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অনিয়ন্ত্রিত রিকশা যানজট ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। আমি মনে করি, রিকশা হবে বাসের সহযোগী। গুলশান-বনানী-বারিধারা-ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় যেমন স্বতন্ত্র রাস্তায় রিকশা চলে, তেমনিভাবে রিকশাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।

একই সঙ্গে বিআরটিএর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিআরটিএ ১০০ জন ইনস্ট্রাক্টর দিয়ে ২৫ হাজার গাড়ির ফিটনেস কীভাবে নিশ্চিত করবে? ফিটনেস সার্টিফিকেট দিতে যেসব বিষয় দেখা হয়, এ জনবল দিয়ে সবগুলো নিশ্চিত করা আকাশকুসুম চিন্তা ছাড়া কিছু নয়। আবার চালকের যে সার্টিফিকেট দিচ্ছে, সেখানেও ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। একজন চালক যেখানে গাড়ি চালাবেন, নিয়ম হলো সেখানে তাকে গাড়ি চালিয়ে দেখাতে হবে। চালককে পরীক্ষার জন্য কম্পাউন্ড ও জিগজাগ সড়কে গাড়ি চালানো দেখা তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। শর্টকাট নিয়মে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করতে হবে। আবার বিআরটিএ বড় বাসের নিবন্ধন দিচ্ছে চালক তৈরি না করেই! যে পরিমাণ বাস রয়েছে তার সিকিভাগ চালকও নেই। এসব ব্যাপারে বিআরটিএর জবাবদিহি দরকার। এত সব দুর্বলতা ও ঘাটতি থাকার একটি টেকসই সড়ক পরিবহন আইন কীভাবে সম্ভব?

আরেকটি বিষয়, আমাদের আইনের কিন্তু অভাব নেই, প্রয়োগের অভাব। আমরা দেখেছি, আইন কারও জন্য প্রয়োগ করা হয় আবার কাউকে ছাড় দেওয়া হয়। আইন প্রয়োগে শিথিলতা ও দুর্বলতা আইনকে অসহায় করে ফেলে। আইন প্রয়োগের ব্যাপারে নিরপেক্ষতা, দৃঢ়তা ও সততা জরুরি। আমরা জানি, সরকারের অনেক অর্জন রয়েছে। পরিবহনেও সরকারের অর্জন জরুরি। অথচ তা ঝুঁকির মুখে। একটি ধারাবাহিক সরকার গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলা দূর করতে পারেনি- এই ব্লেমটা দুঃখজনক হবে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, রুট পারমিট ও ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানকারী সংস্থাকে দায়বদ্ধ থেকে কাজ করে তাদের ভুল শোধরাতে হবে। তাদের যেহেতু আইন নেই, তাদের জন্য সতর্কবার্তা থাকতে হবে। এসব নিশ্চিত হলে আইনের মাধ্যমে ধাপে ধাপে একটি সুশৃঙ্খল শহরে পরিণত করা যাবে। ঢাকা শহর ঠিক হয়ে গেল, অন্য শহরগুলোতেও সে উদাহরণ প্রয়োগ করা যাবে। সেটি হবে ২০৪১ সালের একটি ফাউন্ডেশন। এখন আর দিকনির্দেশনা না দিয়ে সরকারকে নিবিড় নজরদারির মাধ্যমে তা নিশ্চিত করতে হবে।

ড. শামসুল হক; গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)

উত্তর দিন

Please enter your comment!
Please enter your name here

five + seven =