ভর্তি পরীক্ষার জন্য আজ ও আগামীকাল আন্দোলন স্থগিত করলেও আবরার ফাহাদ হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সহসাই রাজপথ ছাড়ছেন না। হত্যা মামলা দ্রম্নত বিচার ট্রাইবু্যনালে হস্তান্তর, মামলার চার্জশিট এবং হলে হলে রাজনৈতিক রুম ও অফিস বন্ধ না করা পর্যন্ত রাজপথে থাকতে চায় তারা। একই সঙ্গে অন্যান্য দাবিগুলোর দৃশ্যমান বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আরও এক সপ্তাহ সময় দিতে চায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের এ কঠোর অবস্থানের কথা জানা গেছে।
৫ দফা দাবি মেনে নেয়া বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার জন?্য ১৩ ও ১৪ অক্টোবর আন্দোলন শিথিল থাকবে বলে জানান আন্দোলনকারীরা। শিক্ষার্থীরা শনিবার বলেন, ‘আমরা আজ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত আন্দোলন শিথিল রাখছি। দ্রম্নত মানা যায় এমন কিছু দাবি প্রশাসন মেনে নেওয়ায় আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে যে ১০ দফা দাবি রয়েছে সেগুলোর বিষয়ে প্রশাসনের সুনির্দিষ্ট বক্তব্য এখনও পাইনি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলে তাদের দাবিগুলো একদিনেই পূরণ করা সম্ভব। প্রশাসনকে সেই সময়টুকু আমরা দিতে চাই। এর মধ্যে দাবির পক্ষে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ১৪ তারিখের পর ফের আন্দোলনে নামব।’
শনিবার সকাল থেকে বুয়েট ক্যাম্পাসে দাবির পক্ষে বিভিন্ন স্স্নোগান দিয়ে মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। দুপুরে একদল শিক্ষার্থী বুয়েটের দেয়ালে দেয়ালে আবরার হত্যাকারীদের দানব আখ্যা দিয়ে প্রতীকী ছবি এঁকে তাদের শাস্তি চান। তারা বলেন, ‘আবরার হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলনের মাঠে থাকব।’
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের ১০ দফা দাবির প্রায় সব’কটি মেনে নিলেও ‘আশ্বাসে বিশ্বাস’ রাখতে পারছেন না তারা। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করলেও হলে ছাত্র সংগঠনের দখলে থাকা রুম উদ্ধার এবং প্রত্যেক হলের প্রভোস্টসহ প্রশাসনের রদবদল করে ঢেলে সাজাতে হবে। সেই সঙ্গে হলগুলোতে বহিরাগতদের আনাগোনা বন্ধে ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা চৌকি আরও জোরদার করতে হবে। এসব বিষয়ে যখন প্রশাসন দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিবে তখন আন্দোলন থেকে তারা সরে আসবেন।
শনিবার শিক্ষার্থীদের বড় ৫টি দাবি মেনে নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে বুয়েট কর্তৃপক্ষ। ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমানের স্বাক্ষর করা এক অফিস আদেশ ও ৪টি বিজ্ঞপ্তিতে আন্দোলনকারীদের এসব দাবি মেনে নেওয়ার কথা জানানো হয়। মেনে নেওয়া দাবিগুলো হলো, হত্যাকান্ডে জড়িত সবাইকে সাময়িক বহিষ্কার, পরে অভিযোগপত্রে যাদের নাম আসবে, তাদেরও স্থায়ীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হবে, আবরার হত্যা মামলার সব খরচ বুয়েট প্রশাসন বহন করবে ও তার পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে বুয়েট প্রশাসন বাধ্য থাকবে, বুয়েটে সব রাজনৈতিক সংগঠন এবং এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ, বুয়েটের্ যাগের নামে নির্যাতনের ঘটনা সংক্রান্ত অভিযোগ প্রকাশের জন্য একটি ওয়েব পোর্টাল তৈরি করা হবে ও অভিযোগ দ্রম্নত নিষ্পত্তি করা হবে এবং সব হলের দুই পাশে প্রতি ফ্লোরে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে।
সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার পর অ্যাকশন শুরু করেছে বুয়েট প্রশাসন। সব হলে পাঁচজন করে সিনিয়র শিক্ষক নিয়ে অভিযান চালাচ্ছে প্রশাসন। এরই অংশ হিসেবে শনিবার বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জামিউস সানি ও সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেলের রুম সিলগালা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আহসান উলস্নাহ হলের ৩২১ নম্বর রুমে থাকতেন বুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি জামিউস সানি। শেরেবাংলা হলে ৩০১২ নম্বর রুমে থাকতেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল। তিনি আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। শনিবার দুপুরে বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান রুমটি সিলগালা করে দেন।
এর আগে বুয়েটের হলগুলো থেকে সিট দখলকারীদের উচ্ছেদ ও ছাত্রসংগঠনগুলোর অফিস সিলগালা করার নির্দেশনা জারি করে কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমানের স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এ নির্দেশনা দেয়া হয়। নির্দেশনায় বলা হয়, অবৈধভাবে যারা হলের সিট দখল করে আছে, তাদেরকে হলের সিট খালি করা, ছাত্রসংগঠনগুলোর অফিস কক্ষ বন্ধ করে তা সিলগালা করার জন্য ছাত্রকল্যাণ পরিচালক ব্যবস্থা নিবেন।
শুক্রবার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈঠকে ভিসি ড. সাইফুল ইসলাম হলে হলের্ যাগের নামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন বন্ধ, বহিরাগতদের বের করা, মাদকের বিরুদ্ধে রাত থেকেই অভিযানে নামার কথা জানান। এ ব্যাপারে ছাত্র কল্যাণ দপ্তরের পরিচালক (ডিএসডবিস্নউ) অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান জানান, শনিবার রাত থেকেই আরও বড় ধরনের অভিযানে নামা হবে। তিনি বলেন, প্রতিটি হলেই বহিরাগতরা থাকে, সাবেক শিক্ষার্থী থাকে, তাদের বের করে দেয়া হবে। এছাড়া মাদক ও অস্ত্রশস্ত্র যদি থাকে তা উদ্ধারে অভিযান চালানো হবে। তিনি বলেন, পাস করেও ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী হলে থাকছেন। তিনজন থাকার জন?্য নির্ধারিত রুমে একজন থাকা ও রাজনৈতিকভাবে দখল করা রুম দখলমুক্ত করতে এ অভিযান নিয়মিত চালাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বুয়েটের হলগুলোয় আবাসিক শিক্ষার্থী থাকার কথা থাকলেও ছাত্রলীগের আশ্রয়ে বিভিন্ন হলে প্রায় শতাধিক বহিরাগতের আনাগোনা ছিল। যারা ক্যাম্পাসে মাদক, ইয়াবা বিক্রিসহ বিভিন্ন কুকর্মের সঙ্গে যুক্ত। আবরারের নির্যাতনের দিন শেরে বাংলা হলেও তাদের দেখা গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এসব বহিরাগত ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন হলের পলিটিক্যাল রুমে রাত্রিযাপন করত।
শহীদ মিনার চত্বরে কম্পিউটার সায়েন্সের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমি আহসান উলস্নাহ হলে আবাসিক ছাত্র। এ হলে দুই বছর ধরে আছি। হলে কে আবাসিক কে বহিরাগত সবাইকে চিনি। কিন্তু এতো দিন ভয়ে কিছু বলতে পারিনি। এখন প্রশাসন আমাদের কাছে জানতে চাইলে নামসহ বলতে পারব।’ তিনি বলেন, ছাত্রলীগের সভাপতি এ হলে থাকার কারণে প্রতি রাতে ১০-১২ জন বহিরাগতর হলে আনাগোনা থাকত। সবাই জানে কিন্তু ভয়ে কেউ মুখ খুলে না। আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র একজন ইউরিপোর্টারে এ অভিযোগ করার পর একদিন প্রক্টোরিয়াল টিম অভিযানে এসেও ছাত্রলীগে বাধার মুখে ফিরে যায়। একদিন পর থেকেই সেই অপরিচিত মুখগুলো আবার আসা শুরু করে।
শহীদ মিনারে আরও দুই শিক্ষার্থী জানান, প্রত্যেক হলে বহিরাগতদের থাকার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। তারপরও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তারা ১০ দফার সঙ্গে বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে কোনো অবস্থায় যেন ঢুকতে না পারে এবং রাতে হলে অবস্থান করতে না পারে সেই দাবিটি যুক্ত করেছেন। এসব বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে অস্ত্র, মাদকসহ সব অন্যায় কাজের সঙ্গে যুক্ত। প্রক্টোরিয়াল টিমসহ প্রশাসনের নাকে ডগায় তারা ক্যাম্পাসে চলাফেরা করলেও তাদের কেউ ধরছে না।