আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর আন্দোলনে ফুঁসে ওঠা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবরার হত্যা মামলার এজাহারে নাম থাকা ১৯ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিস্কার করা হয়েছে ।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে বুয়েট অডিটরিয়ামে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আড়াই ঘণ্টার বৈঠকে এসব সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম। গত রোববার রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নির্যাতনে আবরার হত্যাকাণ্ডের পরপরই আসতে না পারা ও জানাজায় উপস্থিত না হতে পারার জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে তার ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন উপাচার্য।
বৈঠকে উপস্থিত শিক্ষকরা স্বীকার করেন, তারা ছাত্রলীগ নেতাদের দাপটের কাছে অসহায় ছিলেন; সাধারণ শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে পারেননি। অতীতে যেসব নির্যাতন হয়েছে, তার প্রতিকার করা হবে।
আবরার হত্যাকাণ্ডের পর শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস নিরাপদ করতে পাঁচ দিন ধরে ১০ দফা দাবিতে আন্দোলন করছেন। উপাচার্য দাবি করেন, শিক্ষার্থীদের ১০ দফা মেনে নেওয়া হয়েছে। আন্দোলনকারীরা এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাই সমঝোতা ছাড়াই শেষ হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের বৈঠক। আগামী পরশু ১৪ অক্টোবর বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষা হবে কি-না, তা এখনও অনিশ্চিত।
বৈঠকের পর রাত ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা জানান, তাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। ভর্তি পরীক্ষার্থীদের সুবিধার্থে আগামী দু’দিনের মধ্যে তাদের ১০ দফা থেকে পাঁচটি বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের সামনে লিখিত বক্তব্যে দাবিনামা তুলে ধরেন তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস বিভাগের ১৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সায়েম।
এতে বলা হয়, শুধু এজাহারভুক্ত আসামি নয়, আবরার হত্যায় যারা জড়িত, তাদের সবাইকে সাময়িক বহিস্কার করতে হবে। চার্জশিটে যাদের নাম আসবে, তাদের স্থায়ীভাবে বহিস্কার করতে হবে। আবরার হত্যা মামলার খরচ বুয়েটকে বহন করতে হবে এবং তার পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। বুয়েটের হলে থাকা সব অবৈধ বাসিন্দাকে উৎখাত করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সব রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যালয় উচ্ছেদ করতে হবে। অতীতে হলগুলোতে যেসব ছাত্র নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তা প্রকাশ ও দায়ীদের শাস্তি দিতে হবে। প্রতিটি হলের সব তলায় উভয় উইংয়ে সিসি ক্যামেরা লাগাতে হবে। এসব দাবি পূরণের নিশ্চয়তা দিয়ে নোটিশ জারির শর্তও দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
উপাচার্যকে বৈঠকে বসতে শুক্রবার দুপুর ২টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। তাদের দাবি মেনে বিকেল সাড়ে ৫টায় ক্যাম্পাসে আসেন উপাচার্য। বুয়েটের সব অনুষদের ডিন, বিভাগীয় প্রধান, ছাত্রকল্যাণ পরিচালক ও শিক্ষক সমিতির নেতারা বৈঠকে অংশ নেন। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে অডিটরিয়াম ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। আলোচনা চলাকালে কোনো গণমাধ্যমকে সরাসরি সম্প্রচার এবং কোনো ধরনের প্রশ্ন না করার শর্ত দিয়ে আলোচনায় বসেন উপাচার্য। মিলনায়তনের বাইরেও ছিলেন বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী।
উপাচার্যের সঙ্গে বৈঠকে যা হলো :আবরার ফাহাদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালনের মাধ্যমে শুরু হয় বৈঠক। উপাচার্য জানান, শিক্ষামন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আশ্বাস পাওয়া গেছে। শিক্ষার্থীদের ১০ দফার প্রথম দাবি আবরারের হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে সরকারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করা হচ্ছে।
আন্দোলনকারীদের দ্বিতীয় দাবি সিসিটিভির ফুটেজ দেখে আবরারের খুনিদের শনাক্ত করে তাদের স্থায়ী বহিস্কার করা। উপাচার্য বলেন, যাদের নাম এজাহারে রয়েছে, তাদের সাময়িক বহিস্কার করা হয়েছে। অতীতে দেখা গেছে, কাউকে বহিস্কার করা হলে আদালতের আদেশ নিয়ে ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখে। আবরারের খুনিরা যেন এ সুযোগ না পায়, তাই পূর্ণাঙ্গ তদন্তের পর তাদের স্থায়ীভাবে বহিস্কার করা হবে। উপাচার্যের এ প্রতিশ্রুতির পরও শিক্ষার্থীরা দাবি জানাতে থাকেন, অবিলম্বে স্থায়ী বহিস্কার করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের চতুর্থ দাবি, আবরার হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা। এ দাবির বিষয়ে উপাচার্য বলেন, মামলা ট্রাইব্যুনালে নিতে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। পঞ্চম দাবি দ্রুত চার্জশিট প্রদানের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হবে। মামলার সব হালনাগাদ তথ্য শিক্ষার্থীদের জানানো হবে।
নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি পূরণের ঘোষণা দেন উপাচার্য সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সকল রাজনৈতিক সংগঠন ও তার কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হলো।’ এ ঘোষণাকে তুমুল করতালি দিয়ে স্বাগত জানান শিক্ষার্থীরা। উপাচার্য জানান, ছাত্রলীগের বুয়েট শাখা কমিটি বিলুপ্ত করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। ছাত্রলীগ কমিটি বিলুক্ত করবে।
শিক্ষার্থীরা এ সময় প্রশ্ন তোলেন, ২০০২ সালে ছাত্রদলের দুই পক্ষের গোলাগুলিতে সাবেকুন নাহার সনি নিহত হওয়ার পরও ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ২০০৯ সালে আবার তা শুরু হয়। আন্দোলন স্তিমিত হলে আবার রাজনীতি শুরু হবে না- এর নিশ্চয়তা কী? এর জবাবে উপাচার্য বলেন, কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের মুখে তিনি বলেন, স্থায়ীভাবেই রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পরও যারা এ কাজে যুক্ত থাকবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
১৯৬৫ সালের অধ্যাদেশ দিয়ে চলছে বুয়েট। ওই অধ্যাদেশ অনুযায়ী বুয়েটে এমনিতে রাজনীতি নিষিদ্ধ বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তার ছাত্রসংগঠন বুয়েটে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করে। বর্তমান ছাত্রলীগ ছাড়া আর কোনো সংগঠন সক্রিয় নেই বুয়েটে। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের মাধ্যমে প্রকারান্তরে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হলো দেশ সেরা এই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বুয়েটের হলগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন প্রতিদিনের ঘটনা। আবরার হত্যার পর একের পর এক নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ্যে আসছে। উপাচার্য বলেন, এসব ঘটনার কিছুই তিনি জানতেন না। কেউ তাকে জানায়নি। অতীতের নির্যাতনের ঘটনার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন তিনি। মাস কয়েক আগে আহসানউল্লাহ ও সোহরাওয়ার্দী হলে ছাত্র নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন তিনি। দাবির মুখে সন্ত্রাসে জড়িত শিক্ষার্থীদের ছাত্রত্ব বাতিলেরও ঘোষণা দেন।
ক্ষমা চাইলেন উপাচার্য :খবর পেয়েও শেরেবাংলা হলে না যাওয়া ও জানাজায় উপস্থিত না হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন বুয়েট উপাচার্য। আবরারকে হত্যার পরের দিনগুলোতে কী কী গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত ছিলেন, তার ফিরিস্তি দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার ঘাটতি ছিল, পিতৃতুল্য হিসেবে আমি তোমাদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।’
এরপর আগামী সোমবারের ভর্তি পরীক্ষা যেন হতে পারে, সে জন্য শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা কামনা করেন উপাচার্য। কিন্তু কানায় কানায় পূর্ণ মিলনায়তন থেকে ‘না’ ‘না’ জবাব পান। শিক্ষার্থীরা বলেন, যারা শিক্ষার্থীদের নিয়মিত নির্যাতন করে, তারা এখনও হলে রয়েছে। তিনজনের কক্ষ একা দখল করে রেখেছে ছাত্রনেতারা। তাদের উচ্ছেদ ও আবরারের খুনিদের স্থায়ী বহিস্কারের আগে ভর্তি পরীক্ষা হতে দেওয়া হবে না। এর জবাবে উপাচার্য বলেন, উচ্ছেদ করতে পুলিশের সহায়তা লাগবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন সব বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে অভিযান হবে। বুয়েটেও হবে। শিক্ষকরা একা পারবেন না।
এ সময় বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানসহ একাধিক ডিন ও অধ্যাপক অনুরোধ করেন, ভর্তি পরীক্ষায় যেন বাধা দেওয়া না হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এতে রাজি হননি; বরং তারা অভিযোগ করেন, অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ছাত্রলীগের মডারেটর। শিক্ষকরা ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অতিথি হন। ছাত্রলীগের মডারেটরের দায়িত্বে থাকার কথা অস্বীকার করেন মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে আর কোনো শিক্ষক কোনো রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের কর্মসূচিতে অতিথি হবেন না। শিক্ষকরাও রাজনীতিতে জড়াবেন না বলে বলে ঘোষণা দেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এ কে এম মাসুদ।
গতকালের বুয়েট ক্যাম্পাস :অন্যান্য দিনের মতো গতকাল শুক্রবার সকালেও ১০ দফা দাবিতে ক্যাম্পাসে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সকাল ১১টার দিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। শিক্ষার্থীরা সাংবাদিকদের বলেন, আবরারের লাশকে পুঁজি করে বহিরাগত কেউ নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালালে তা প্রতিহত করা হবে। তারা হত্যার বিচার চান, কাউকে যেন আবরারের পরিণতি বরণ করতে না হয়। ব্রিফ শেষে আবার বিক্ষোভ মিছিল হয়। তখন আবরার হত্যাকাণ্ডের পথনাটকও প্রদর্শন করেন তারা।
সন্দেহভাজন যুবক আটক :সকাল ১০টার দিকে বুয়েটে সন্দেহভাজন এক যুবককে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন আন্দোলনকারীরা। আটক যুবকের নাম এনামুল মোর্শেদ রুপম। জানা যায়, বুয়েটের কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ার সামনে তাকে দেখে পরিচয় জানতে চান শিক্ষার্থীরা। কিন্তু তিনি একেকবার একেক বিভাগ ও ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দেন। তখন শিক্ষার্থীরা তাকে পুলিশে দেয়।