বিশ্ব শিক্ষক দিবস ছিল গত ৫ অক্টোবর। এই দিবসকে কেন্দ্র করেই আজ আমার এ লেখা। কারণ শিক্ষকরা আছেন বলেই হয়ত মানব সমাজ টিকে আছে। তবে হ্যাঁ, এই শিক্ষকদের কাতারে শুধু মূল ধারার শিক্ষকদেরকে যুক্ত করলেই হবে না, যোগ করতে হবে একটি মানুষের জীবনের সব শিক্ষককে যারা বইয়ের বিদ্যা শেখাননি বটে তবে জীবনের শিক্ষা দিয়েছেন।

আমার নিজের জীবনের স্মৃতিচারণ করে বলছি, একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বলেছিলেন, কলম দিয়ে যেন মিথ্যা না লিখি। আজ ও প্রতিটি শব্দ লেখবার আগে ভেবে নেই, সত্যি লিখছি তো?

একটি মানুষের জীবনের সর্বপ্রথম শিক্ষক তার মা, ক্ষেত্রবিশেষে বাবা। মা এবং বাবা শিখিয়ে থাকেন জীবনের প্রথম শিক্ষাটি; কীভাবে জীবন যাপন করতে হয়। এ শিক্ষাটি বাবা এবং মা বই থেকে শেখান না বটে, তবে জীবন থেকে শেখান। তাই বাবা মা একটি মানুষের জীবনের সর্ব প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক। একটি শিশু তার নিজের জীবনে তার বাবা এবং মায়ের জীবন ধারাকে আত্মস্থ করে। তাই, একজন মা যদি চান যে তার সন্তান বই পড়বে, তিনি যেন নিজে বই পড়েন। কারণ একটি শিশুকে মুখে যা শেখানো হয় তা সে করে না, বরং যা সে দেখে তাই করে থাকে। এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে, কোনো কোনো শিশুকে দেখা যায়, যে সে অনবরত মিথ্যা বলছে। আমি শতভাগ নিশ্চিত যে তার বাবা-মা তাকে অনেক বার মিথ্যা বলতে নিষেধ করেছেন, কিন্তু তাও সে মিথ্যা বলছে। কারণ মিথ্যাকে শিশুটি ধারণ করেছে তার আশেপাশের পরিবেশ থেকে। সুতরাং বাবা-মা হিসেবে ভালো শিক্ষক হতে হলে, আচরণটি নিজেদের মধ্যে ধারণ করা প্রয়োজন বলে মনে করি।

এবার আসা যাক পুঁথিগত শিক্ষা এবং শিক্ষক প্রসঙ্গে। নার্সারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত একজন মানুষ তার জীবনে বিভিন্ন রকম শিক্ষকের মুখোমুখি হয়ে থাকে। সংগত কারণে, তাদের মধ্যে সবাই নীতি এবং নৈতিকতার দিক থেকে উচ্চগুণসম্পন্ন হবেন তা ভাবাটা বোধহয়য় সমীচীন নয়।

একজন শিক্ষক কী চরমভাবে একজন শিক্ষার্থীকে প্রভাবিত করতে পারে, তার উদাহরণ ‘নুসরাত’ এর ঘটনাটি খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়। নুসরাত মেয়েটিকে যে বা যারা হত্যা করেছে, তারা প্রায় সবাই সেই দুষ্কৃতিকারী হেডমাস্টারের ছাত্র। কী ভয়াবহভাবে কিছু শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষকের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে তা ভাবতেই গা শিউরে উঠে। তাছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ চিত্রটি খুব সচরাচর ঘটে থাকে যে, একজন নির্দিষ্ট শিক্ষকের পরামর্শক্রমে কিছু ছাত্র একজন নিরীহ শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনে থাকে। এমনও হয় যে একজন নির্দিষ্ট শিক্ষকের ছায়াতলে কিছু শিক্ষার্থীর একটি দল গড়ে ওঠে। এ কথাগুলো যতটা বিস্ময়কর ঠিক ততটাই সত্য। তাছাড়া উপহার দেওয়া এবং নেওয়ার প্রচলন তো আছেই।

একটি নির্দিষ্ট শিক্ষক কিছু নির্দিষ্ট শিক্ষার্থীর কাছ থেকে কীভাবে উপহার গ্রহণ করতে পারেন তা সত্যিই আমার বোধগম্য নয়। কারণ, উপহার নেওয়া এবং দেওয়ার ফলে পক্ষপাতিত্বের সম্ভাবনা তো থাকছেই, তাছাড়া অন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে চরম অনাস্থা জন্ম নেওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়।

একজন শিক্ষক নৈতিকতা শেখাবেন এটাই তো স্বাভাবিক। কারণ বইয়ের বিদ্যা শেখার জন্য সত্যি বলতে শিক্ষক না হলেও চলে। এমন অনেক শিক্ষার্থী আছেন যারা এতটাই বুধিমত্তাসম্পন্ন যে, নিজেরাই বই পরে এবং বিভিন্ন বইয়ের ব্যাখ্যা একত্রিত করে তারা পাঠ্যবস্তু খুব সহজেই রপ্ত করতে পারে। একটি উদাহরণ দিয়ে বলছি, এক শিক্ষক ক্লাসে নাকি বলেছিলেন, ‘মেয়েমানুষ বাংলাদেশের আদালতে কাজ করার যোগ্য না।’ সেদিন বেশকয়েকজন মেয়ে মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন যে তারা আর যাই করুন না কেন, আদালত প্রাঙ্গণে ধর্না দিচ্ছেন না। বলাবাহুল্য, ওই একজন শিক্ষক বেশ কয়েকজন উজ্জ্বল নক্ষত্রকে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে আগেই ঝরে যেতে সহায়তা করেছিলেন। একজন শিক্ষক যদি তার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত রসালাপ জুড়ে দেন, তাহলে শ্রদ্ধার জায়গাটি বোধহয় হারিয়ে যাবে।

আশা করি, লেখাটি পড়ে কারো মনে অত্যন্ত রক্ষণশীল একজন শিক্ষকের চিত্র ভেসে উঠছে না। কারণ মাত্রাতিরিক্ত রসালাপ করা শিক্ষক যেমন কাম্য নয়, তেমন রুঢ়, গম্ভীর একজন শিক্ষকও কাম্য নয়। শিক্ষক হবে বন্ধুতার উরধে, শ্রদ্ধার স্থানে। একজন শিক্ষকই পারে একজন দুর্বল শিক্ষার্থীকে তার সুপ্ত প্রতিভাগুলো বিকশিত করতে সহায়তা করতে পারে। ভালো ছাত্রদের সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকের প্রয়োজন হয় না, বরং অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীদের অনেক বেশি প্রয়োজন শিক্ষককে।

আমাদের সমাজে হরহামেশাই দেখা যায়, শিক্ষকেরা ভালো ছাত্রদের দিকে অধিক মনোযোগ দিয়ে থাকেন, তাদের কিছু ক্ষেত্রে সহযোগিতার ক্ষেত্রেও অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। কারণ ভালো ছাত্ররা তাদের জন্য কষ্টের কারণ নয়। খুব সহজেই পাঠ্য বুঝতে পারা, অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখা, বার বার পড়া বোঝানোর প্রয়োজন না থাকা ইত্যাদি কারণে তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের বেশি প্রিয়। সেই সঙ্গে এ কথাও বলে রাখা ভালো যে, এ কথাটি সর্বক্ষেত্রে সত্য নয়, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সত্য। অথচ অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থী কিছুটা ভয়ে এবং সংকোচে শিক্ষকের সামনেই আসতে চায় না অথবা আসে না।

এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, এই দুর্বল শিক্ষার্থীর অনেক বেশি প্রয়োজন শিক্ষককে। শিক্ষকের অতিরিক্ত সময় তার খুব দরকার। শিক্ষক এই শিক্ষার্থীকে যত বেশি সাহস যোগাবেন, সে তত বেশি ভালো করবে। আর সেটাই তো শিক্ষকতার সফলতা।

তবে হ্যাঁ, এ সমাজ এমন অনেক শিক্ষকের উদাহরণ বয়ে চলছে, যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়িয়েছেন কোনো রকম পারিশ্রমিক ছাড়াই, শিক্ষার্থীর চাকরির ব্যবস্থা করেছেন, জীবনের অনেক কঠিন সময়ে পাশে থেকেছেন, অভিভাবকের সব দায়িত্ব পালন করেছেন। সব প্রতিবন্ধকটা আর সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে অসংখ্য শিক্ষক তাদের জীবন উজার করে দিয়েছেন সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের পেছনে। তাদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম। বিশ্ব শিক্ষক দিবসের শুভেচ্ছা সব মানুষ গড়ার কারিগরদেরকে।

লেখক : আফরিন ইসলাম, সিনিয়র লেকচারার, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি।

উত্তর দিন

Please enter your comment!
Please enter your name here

12 − 7 =