করোনাকালের আলোচিত প্রতারক সাহেদ করিম অনেক কৌশল করেও পালাতে পারলো না। ৯ দিন পলাতক থাকার পর ধরা পড়ে গেলেন র‌্যাবের হাতে। গতকাল বুধবার (১৫ জুলাই ) ভোরে সাতক্ষীরার দেবহাটা সীমান্তের লবঙ্গবাতি খাল দিয়ে নৌকায় করে ভারতে পালানোর সময় তাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

রিজেন্ট হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার নামে প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর একের পর এক মুখোশ উন্মোচিত হতে থাকে সাহেদের। গত ৬ জুলাই রিজেন্টের উত্তরা ও মিরপুর কার্যালয় সিলগালা করা হয়। এ সময় থেকেই পলাতক ছিলেন সাহেদ। গ্রেপ্তার এড়াতে প্রথমে প্রভাবশালীদের দ্বারস্থ হন। তাতে সুবিধা না হওয়ায় ছদ্মবেশ নিয়ে ভারতে পালানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি। একাধিক জেলায় আত্মগোপনে ছিলেন গ্রেপ্তার এড়াতে। এর মধ্যে কয়েকবার ঢাকায়ও আসা-যাওয়া করেছেন।

গ্রেপ্তারের সময় সাহেদ বোরকা পরিহিত অবস্থায় ছিলেন। কোমরে ছিল গুলিভর্তি পিস্তল। তবে অভিযানের সময় র‌্যাবের সঙ্গে তার কোনো গোলাগুলির ঘটনা ঘটেনি। গ্রেপ্তারের পর ভোরেই তাকে হেলিকপ্টারে ঢাকায় আনা হয়। এরপর সাহেদকে নিয়ে উত্তরায় তার একটি গোপন আস্তানায় অভিযান চালিয়ে জাল মুদ্রা উদ্ধার করে র‌্যাব। প্রতারক সাহেদকে গতকাল সন্ধ্যায় মামলার তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তার আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হয়। আগামীকাল ডিবি তাকে আদালতের মাধ্যমে ১০ দিনের রিমান্ড চাইবে। সাহেদের বিরুদ্ধে গতকাল রাতে দেবহাটা থানায় অস্ত্র আইনে মামলা করেছে র‌্যাব।

সাহেদের ৯ দিনের পলাতক জীবন : সাহেদকে গ্রেপ্তারের পর গতকাল উত্তরায় র‌্যাব সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন র‌্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, একেক দিন একেক জায়গায় আত্মগোপনে ছিলেন সাহেদ। ঢাকা, কক্সবাজার, কুমিল্লা, সাতক্ষীরা অঞ্চলে সুকৌশলে লুকিয়ে ছিলেন। তার ঢাকায়ও আসা-যাওয়া ছিল। পুরো সময়টাতে তিনি কখনও ব্যক্তিগত গাড়ি, কখনও হেঁটে, কখনও ট্রাকে চলাচল করছিলেন। র‌্যাব তাকে অনুসরণ করছিল। তবে সুনির্দিষ্টভাবে কোথায় রয়েছেন, তা জানা যাচ্ছিল না। বারবার স্থান বদল করতে থাকেন সাহেদ। অবশেষে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগেই তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়। নৌকা দিয়ে সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি।

যেভাবে অভিযান :র‌্যাব মহাপরিচালক জানান, কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ৬ জুলাই র‌্যাব উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালায়। এ সময় বেশ কিছু অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়। তার মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স, করোনার ভুয়া সনদ প্রদান, অর্থের বিনিময়ে করোনার পরীক্ষা ও চিকিৎসা, অনুমতি ছাড়া বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ, করোনার চিকিৎসায় অব্যবস্থাপনা, জিডির মাধ্যমে অপরাধ গোপনের চেষ্টা, প্যাথলজিক্যাল সেন্টার স্থাপনের অনুমতি নিয়ে হাসপাতাল পরিচালনা ইত্যাদি। এসব অভিযোগে রিজেন্টের দুটি কার্যালয় সিলগালা করা হয়। ১৭ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। মামলার ১৭ আসামির মধ্যে আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সাহেদের অনিয়ম-দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ হতে থাকে। দেশবাসীর কাছে তার গ্রেপ্তারের বিষয়টি একটি প্রত্যাশার জায়গা হয়ে দাঁড়ায়। র‌্যাব তাদের পেশাদারি দায়িত্ববোধ থেকে তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করা হয়। সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়। ধারাবাহিক অভিযানে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সাহেদের প্রতারণার অন্যতম সহযোগী রিজেন্ট গ্রুপের এমডি মাসুদ পারভেজকে গাজীপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পলাতক সাহেদের সম্ভাব্য পরিকল্পনা এবং অবস্থান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মেলে। সাহেদের দেশত্যাগের কয়েকটি পরিকল্পনা র‌্যাবকে অবহিত করে মাসুদ। এরপর সাতক্ষীরা, বেনাপোলসহ সীমান্তবর্তী এলাকার গমনাগমনের রাস্তায় নজরদারি বাড়ানো হয়। প্রাপ্ত তথ্য যাচাই করে সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হয়। র‌্যাবের গোয়েন্দাপ্রধানের নেতৃত্বে আভিযানিক নেটওয়ার্ক সুদৃঢ় করা হয়। র‌্যাব সদর দপ্তর সার্বিক মনিটর করে। গতকাল ভোর ৫টার দিকে পার্শ্ববর্তী দেশে পালানোর সময় অস্ত্র-গুলিসহ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

চতুর, ধুরন্ধর ও অর্থলিপ্সু : র‌্যাব জানায়, রিজেন্ট হাসপাতালের কর্ণধার সাহেদ নিজেকে সুধী এবং ক্লিন ইমেজের ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করলেও তিনি মূলত চতুর, ধুরন্ধর ও অর্থলিপ্সু। তার বিরুদ্ধে ৫০টির বেশি মামলা রয়েছে। তিনি নিজেকে কখনও অবসরপ্রাপ্ত, কখনও চাকরিরত সেনা কর্মকর্তা বলে পরিচয় দিতেন। কখনও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার পরিচয়েও চলতেন। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে সুকৌশলে ছবি তুলে সেগুলোকে প্রতারণার কাজে ব্যবহার করতেন। বালু, পাথর ব্যবসা, এমনি রিকশাচালকদের ভুয়া লাইসেন্স দিতেন। এমএলএম কোম্পানির নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলন :সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, যেসব হাসপাতাল রিজেন্ট হাসপাতালের মতো অনৈতিক কর্মকাণ্ড করবে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। আমরা যখনই সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাচ্ছি, তখনই অভিযানে যাচ্ছি। গত ১২ জুলাইও রাজধানীর একটি হাসপাতালে অভিযান হয়েছে। আমাদের অভিযান চলছে। এটি চলমান প্রক্রিয়া।

মহাপরিচালকের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চান- সাহেদের সঙ্গে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির ছবি ও অন্তরঙ্গতার বিষয় সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। পলাতক অবস্থায় তিনি কার কার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন? আলোচনা ছিল, তিনি পুলিশের সাবেক এক কর্মকর্তার বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই কর্মকর্তা কে? জবাবে র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, জিজ্ঞাসাবাদ এখনও শেষ হয়নি। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আরও অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। তিনি একজন প্রতারক। বিভিন্ন সময় নানা কৌশল নিতেন। এ জন্যই আজ তার এই পরিণতি। পালিয়ে থাকার সময় কাদের সহায়তা নিয়েছেন ও সাহেদকে যারা ইন্ধন দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা তদন্ত কর্মকর্তা দেখবেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যারা এই চক্রে ছিল, তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে। এটা মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সাহেদের প্রতারণার শিকার অনেক ভুক্তভোগী আসছেন। তাদের আইনি পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

ছয় হাজার ভুয়া রিপোর্ট :র‌্যাব জানায়, করোনা পরীক্ষা বিনামূল্যে করার কথা থাকলেও সাহেদ প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। প্রথমবার পরীক্ষার নামে ৩৫০০-৪০০০ টাকা করে নেওয়া হতো। দ্বিতীয়বার পরীক্ষার জন্য নেওয়া হতো এক হাজার টাকা। আইসিইউতে ভর্তি করে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করত। ১০ হাজারের অধিক পরীক্ষা করে প্রায় ছয় হাজার ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে সাহেদের প্রতিষ্ঠান। একদিকে রোগীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, অন্যদিকে বিলের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্রও জমা দিয়েছে রিজেন্ট হাসপাতাল।
মুখে এক, কাজে আরেক :’সাহেদকাণ্ড’ সামনে আসার পর টেলিভিশন টকশোতে তার দেওয়া একটি বক্তব্য ভাইরাল হয়ে যায়। সেখানে সাহেদ বলেছিলেন- ‘দুর্নীতিতে জড়ানো কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। এই যে আমি ঢাকায় ৩০ বছর ধরে আছি, কোনোদিন ক্যাসিনোর কথা শুনিনি। অথচ দেখেন এই শহরে কত ক্যাসিনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সরকার অপরাধীকে ছাড় দেবে না বলে নিজের দলের ভেতর থেকে পরিচ্ছন্ন অভিযান শুরু করেছে। এই জিকে শামীমের কথাই ধরুন, সে কি ছাড় পেয়েছে?’ টেলিভিশনের ওই টকশোতে দেওয়া প্রতারক সাহেদের এমন বক্তব্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনার মধ্যে নিজেই দুর্নীতির দায়ে ধরা পড়লেন সাহেদ।

২০১৮ সালে সাহেদ যে স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েছেন তাতে তার নাম ছিল সাহেদ করিম। জন্ম ১৯৭৮ সালের ২ জুন। ২০১৯ সালের মে মাসে এনআইডি বিভাগে নাম ও বয়স পরিবর্তনের আবেদন করেন তিনি। শুধু একটি জন্মসনদ আর ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেটের ফটোকপি দিয়েই এই আবেদন করেন তিনি। জন্মসনদের আবেদনে শুধু একটি পাসপোর্টের ফটোকপি জমা দেন সাহেদ। এনআইডিতে স্নাতক পাস দেখালেও এই আবেদনে তার কিছুই যুক্ত করেননি। এমনকি জন্মস্থান সাতক্ষীরার বদলে দেখান ঢাকা। টকশোর পরিচয় দিয়েই তিনি প্রভাব খাটিয়েছিলেন অবৈধভাবে সনদ নিতে। গত বছরের ২৯ এপ্রিল জন্মসনদ নেওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় তিনি শিক্ষা সনদের কপি দিয়ে নাম বদলের আবেদন করেন। এর পরই সাহেদ করিম থেকে হয়ে যান মোহাম্মদ সাহেদ। শুধু নাম নয়, বয়সও বাড়ান তিন বছর। এমনকি জন্ম তারিখও। ‘নতুন কাগজ’ নামে একটি পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশকও ছিলেন তিনি। ঢাকার নামিদামি ক্লাবে ছিল তার নিয়মিত আড্ডা।

উত্তর দিন

Please enter your comment!
Please enter your name here

eight + nine =